বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিরহ জনগণ ও সেই ধর্মের পুরোহিতদের হত্যা করা হচ্ছে। হত্যাগুলোর দায় স্বীকার করছে ইসলামী খেলাফতকারী দলগুলো। এ বিষয়ে ইসলাম কি বলে? এই হত্যাগুলো কি ইসলাম সম্মত?
সাধারণ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে ধর্মের মধ্যে কোন অন্যায় খুনোখুনি নেই। বিশেষত ইসলাম হচ্ছে সব রকম অন্যায় ও অবিচারে বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা জানেন না ইসলামে অমুসলিমদের আটকিয়ে মুক্তিপণ আদায় থেকে শুরু করে হত্যা করা পর্যন্ত আল্লাহতালার বিধান বলে বিবেচিত। মুশকিল হচ্ছে, ইসলামী আলেমরা আপনাকে ইসলামের গোলকধাঁধাঁয় ফেলে বার বার বিভ্রান্ত করবে। আপনি যখন জানবেন, ইসলাম অমুসলিম নিরহ নাগরিকও শত্রু মনে করে এবং এ জন্য তাকে হত্যা করা জায়েজ তখনই আপনাকে জানানো হবে বদরের যুদ্ধে কাফেরদের বন্দি করেও রসূল্লাহ তাদের হত্যা করেননি। বরং বলেছে তাদের ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতে তারা ইসলাম গ্রহণ করতেও পারে। রসূল্লাহ তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন এই ঘটনা সত্য কিনা, আমি বলব সত্য, কিন্তু এই সত্য মানুষকে ক্ষমা করে দেয়ার মহানুভূতার উপর দাঁড়িয়ে নয়। এটি ছিল নিজ পরিবার ও জাতির প্রতি পক্ষালম্বন। বদরের যুদ্ধে বন্দিদের মধ্যে রসূল্লাহর চাচা ও পরিবারের অনেক সদস্য ছিল। তাদের হত্যা করা হোক এটা তিনি চাচ্ছিলেন না। যদিও তার চাচাকে হত্যা করতে পাগলা কুকুরের মত হয়েছিল আনসাররা। আনসার আবু হাফস নবীর চাচার গর্দান উড়িয়ে দিতে চাইলে রসূল বলেন, হে আবু হাফস, তুমি কি রসূলের চাচার মুখে তরবারি মারবে? সারারাত হযরত মুহাম্মদ আত্মীয়দের চিন্তা ঘুমাতে পারেনি। তার আশংকা আনসার ও তার অনুসারীদের মনে যে ঘৃণা আবু হিশাম গোত্রের উপর তাতে তাদের পরিবারকে বাঁচানো যাবে তো? যে ঘৃণা তিনিই একদিন এদের মনে জ্বালিয়েছিলেন। আজ সেটাই বুমেরাং হয়ে নিজের উপর ফিরে এসেছে। সাহাবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, জিব্রাইল এসে তাকে জানিয়েছেন, হয় এদের হত্যা কর নতুবা এদের মুক্তিপণ দিয়ে ছেড়ে দাও- এ দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলুন আপনার সাহাবীদের। ওমর বললেন, এদের হত্যা করুন। আবু বকর মত দিলেন, মুক্তিপণ দিয়ে ছেড়ে দিন, এরা তো আপনার পরিবার পরিজন…।
কিন্তু নবীজি জানেন এই পরিস্থিতিতে সবাই যে আবু বককের মত তার একান্ত অনুগত থাকবে তা নয়। দলে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তিনি জানেন তার লোভী সাহাবীদের নগদ অর্থ কতটা খুশি করে। তিনি সেই ফাঁদটাই পাতলেন। বললেন, দেখো, তোমরা এখন দারিদ্রপীড়িত, সুতরাং এরা এখন ফিদইয়া (মুক্তির জন্য নগদ অর্থ) ছাড়া মুক্তি পাবে না… (ইবনে কাথিরের তাফসির, সুরা আনফাল, ৮,৯,১০,১১ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১৬- ৬২৩)। এভাবেই বদরের যুদ্ধে বন্দি কাফেরদের অর্থের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়। আর এটাকেই এখন প্রচার করা হচ্ছে, রসূল্লাহ শত্রুকে হাতের কাছে পেয়েও ক্ষমা করে দিতেন। অথচ নবী ইহুদীদের বনু করাইযা গোত্রের কাউকে ক্ষমা করেননি। তাদের নাবালক শিশু (যাদের লিঙ্গের নিচে চুল গজিয়েছে)সহ সাতশ পুরুষকে একরাত্রে হত্যা করা হয়। (ইবনে হিশাম, বণু কুরাইজা অভিযান, পৃষ্ঠা- ২৪১) তাদের নারীদের যৌনদাসী বানানো হয়।
এইসব বালক ও নারীদের কি দোষ ছিল? অথচ বদর যুদ্ধে নিজের বংশের লোকজনকে বাঁচাতে তিনিই যুক্তি খাড়া করেন, আমি খবর পেয়েছি বনি হাশিমের অনেকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আনা হয়েছে… (ইবনে কাথিরের তাফসির, সুরা আনফাল, ৮,৯,১০,১১ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৬১৬-৬২৩)। অর্থ্যাৎ অনিচ্ছায় তার পরিবারের লোকজন যারা যুদ্ধে এসেছিল তার বিরুদ্ধে তাদেরকে আর যাই হোক হত্যা করা যায় না! কিন্তু ইহুদী নারী ও নাবালক শিশুরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল! তাই তাদের কোন ক্ষমা নেই- বাহ!
ইসলামের কোথাও খিলাফত বা জিহাদের পথে অন্তরায় হয়ে থাকা কাফের-মুশরিক অমুসলিমদের হত্যা বিষয়ে নিষেধ নেই। যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেটা অন্য প্রেক্ষাপটে। সে আলোচনায় যাবার আগে জানিয়ে দেই যে, ইসলাম মানুষ হত্যাকে মহাপাপ বলেছে সেটা শুধুমাত্র মুসলিমদের বুঝানো হয়েছে। ইসলামে যত ন্যায় সংগত কথা সবই মুসলিমদের মধ্যে গণ্য। যেমন সুরা নিসায় আছে- “এবং কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন” ( সূরা নিসা:৯৩)। হাদিসে আছে- “কোন মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার তুলনায় সমগ্র পৃথিবীর পতন আল্লাহর দৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার” (মুসলিম)। পরিস্কার করে মুসলিমদের কথা বলা হয়েছে এখানে। তো, অমুসলিমদের বিষয়ে কি আছে?
অমুসলিমদের হত্যা বিষয়ে গোটা কুরআনে এত এত আয়াত আছে যে তার সবটা দিতে গেলে এই লেখার পরিধি বেড়ে সীমানা ক্রস করবে। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কাফের-মুশরিকদের হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে সেটাই বরং দেখাই। হাদিসে আছে- “যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন” (নাসাঈ)।/ “যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করল সে কখনো জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না”( বুখারী)। এই হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলেই এই ভয় ভীতিগুলোর কারণ বুঝা যায়। ‘জিম্মি’ যে খুব গুরুত্বপূর্ণ এটি কোন মাথামোটা কিংবা প্রতিশোধ পরায়ন ব্যক্তি হয়ত নাও বুঝতে চাইতে পারে। জিম্মি দিয়ে নবীজি মুক্তিপণ আদায় করতেন। এমনকি জিম্মি বিনিময় করে বন্দি মুসলিমদের মুক্ত করতেন। চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর হটকারী হামলা হলে রাজনীতির পাশার দান যে ঘুরে যেতে পারে সেটা যে কোন বিচক্ষণ মানুষই বুঝতে সক্ষম।
দাস প্রথা ইসলাম শুধু সমর্থনই করেনি, দুহাতে এর ফয়দা লুটেছে। এই প্রথাকে নিষিদ্ধ করার কথা আল্লাহর একবারও মনে আসেনি। যাই হোক, কাফের-মুশরিকদের জীবনে দুটো ঘটনাই ঘটতে পারত (তবে নবীর বংশ ও পরিবার হলে ভিন্ন কথা!) মৃত্যু অথবা দাস হয়ে মুসলিমদের হাতে বিক্রি হওয়া। মাওলানা আওয়ামী ফরিদউদ্দিন মাসউদের মত আলেমরা দেখবেন সব সময় বলবে, আল্লাহর রসূল জিহাদের সময় নারী ও শিশুদের মারতে নিষেধ করেছেন। ঘটনা কি আসুন একটু বিস্তারিত জেনে আসি। নবীজি তার জীবনের শেষ যুদ্ধ (আক্রমন)হুনাইনের যুদ্ধে নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন। “তিনি (রাসুলুল্লাহ) সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলা ও শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।” [সহীহ বুখারীঃ ৩০১৪, ৩০১৫, সহীহ মুসলিমঃ ১৭৪৪, আবু দাউদঃ ২৬৬৮, তিরমিযীঃ ১৫৬৯, ইবনু মাজাহঃ ২৮৪১, আহমাদঃ ৪৭২৫, মালেকঃ ৯৮১, দারেমী; ২৬৪২] । কিন্তু মদিনার তার ১৩ বছরের জিহাদের জীবনে তিনি তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন উল্টোটাই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মুসলমানদের রাত্রিকালের অভিযানের ফলে শত্রুপক্ষের মুশরিকদের কিছু মহিলা ও শিশুরা নিহত হয়, তাহলে কি হবে? আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বলেছিলেন, “তারা মুশরিকদের সাথে বলেই গণ্য হবে।” [সহীহ বুখারীঃ ৩০১২, ২৩৭০, সহীহ মুসলিমঃ ৭৫৪৫, আবু দাউদঃ ২৬৭২, তিরমিযীঃ ১৫১৭, ইবনু মাজাহঃ ২৮৩৯, আহমাদঃ ২৭৯০২, মালেকঃ ৯৮১, দারেমীঃ ২৬৪২] নারী ও শিশুদের হত্যা করা না হলে তাদের ভাগ্যে দাস হওয়াই ছিল নিয়তি। নারীদের গণিমত হিসেবে বন্টন করা হতো সাহাবীদের মধ্যে। প্রথম যুগে বন্টন হওয়ার আগেই এইসব কাফের নারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ত সাহাবীরা। গর্ভবতী নারীদেরও রেহাই দিতো না। এই জন্য পরবর্তীকালে নিয়ম করা হয়েছিল গণিমত নবী বন্টন করার আগে কেউ ছুঁতেও পারবে না। আল্লাহ গণিমতের ভাগও ঠিক করে দেন।
আজকাল নতুন নতুন আলেম আর ‘গুড মুসলিমদের’ উদয় হয়েছে যারা বলছেন, দেশে চলমান অমুসলিম ও নানা পেশা ও মতবাদের বিভক্ত মুসলিম, নাস্তিকদের যে হত্যা চলছে তা নাকি ইসলাম সম্মত না। ইসলামী আইন ‘কতল বিল হাক্ক’ ৬টি ক্ষেত্রের মধ্যে হত্যাকে জায়েজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ১. জিহাদের ময়দানে সত্য দীনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের হত্যা করা। ২. ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পতনের চেষ্টায় লিপ্তদের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা। বর্তমানে জিহাদীরা ইসলামের এই সন্ত্রাসী আইনকে ধরেই গুপ্ত হত্যা চালাচ্ছে। অমুসলিম নাগরিকদের মনে করা হচ্ছে শতভাগ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবন্ধক হিসেবে। অথচ রোজ শুনি, এইসব হত্যার সঙ্গে নাকি ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই…!
Referal Link: https://www.facebook.com/notes/susupto-pathok/%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%85%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%87/515438258661582
No comments:
Post a Comment